গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর সুস্থতায় খাবার (কি খাবেন ও খাবেন না) – Best Food for Mother and Baby Health During Pregnancy! মাতৃত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিগুলোর একটি। এই সময়ে, স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গর্ভাবস্থায় কেবলমাত্র শারীরিক পরিবর্তন নয়, মানসিক এবং আবেগগত পরিবর্তনেরও লক্ষণীয়। সন্তান জন্মদান একটা মায়ের কাছে যেমন আনন্দের তেমনি কষ্টদায়ক ও শংকাজনকও বৈকি। এ সময়ে মা এবং শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে কিছু বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
মানুষের জীবনের সব পর্যায়েই স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন করা গুরুত্বপূর্ণ। আর গর্ভাবস্থায় এটা বিশেষভাবে জরুরি। এই ব্লগে, আমরা গর্ভাবস্থায় মা এবং শিশুর সুস্থতার জন্য খাবার তালিকা ও প্রয়োজনীয় কিছু টিপস শেয়ার করব। সাথেই থাকুন!
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভাবস্থায় মায়ের সুস্থতা এবং শিশুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ অপরিহার্য। গর্ভাবস্থায় মায়েদের খাদ্য তালিকায় থাকা উচিত প্রচুর ফলমূল, শাকসবজি, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এবং শস্যবীজ।
দিনে কমপক্ষে তিনবার দুধ অথবা দই খাওয়া দরকার, যা ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সরবরাহ করে। মাছ, মাংস, ডাল ও ডিমের মতো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার শিশুর বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
এছাড়া, ফলমূল ও শাকসবজি, বিশেষত লাল, সবুজ এবং হলুদ রঙের সবজি ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা পূরণ করে। ফাইবার সমৃদ্ধ শস্যবীজ, যেমন:- গমের রুটি, ব্রাউন রাইস এবং ওটমিল খাবার হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিৎ। নিচে কততম মাসে কিভাবে গর্ভবতী মায়ের খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ তা নিচে উল্লেখ করা হলো।
অনেক ক্ষেত্রে মায়ের জন্য ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট, ও ।
প্রথম ৩ মাসের গর্ভবতী নারীর খাদ্য তালিকা
গর্ভাবস্থায় আপনি কতটুকু খাবার গ্রহণ করবেন এটা আপনার উচ্চতা, ওজন এবং দৈহিক পরিশ্রমের উপর নির্ভর করবে। সাধারণত প্রথম তিন মাসে খুব একটা বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় না। তবে অন্তত ১৮০০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করা উচিৎ। আপনি এ সময় একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে চলতে পারেন যিনি আপনাকে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করতে সাহায্য করবে।
পরবর্তী মাসগুলোর জন্য গর্ভবতী নারীর খাবার তালিকা
৪ থেকে ৯ মাসের গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪ মাস থেকে শিশু বাড়তে থাকে তাই এ সময় গর্ভবতী নারীর খাদ্য গ্রহণের পরিমানও বাড়িয়ে দিতে হবে।
৪ থেকে ৬ মাসের গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন প্রায় ২১৪০ ক্যালরি এবং ৭ থেকে ৯ মাসের গর্ভবতী নারীর প্রতিদিন ২৩৫০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই সময়ে মায়ের খাদ্য তালিকায় থাকা উচিত এমন কিছু খাবার নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
সকালে একটি পুষ্টিকর নাস্তা দিয়ে দিন শুরু করুন। দুধ বা দইয়ের সঙ্গে ওটমিল বা সবজি দিয়ে গমের রুটি খান। এতে ফাইবার এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যায় যা শক্তি প্রদান করে। যদি ভাত খেতে অভ্যস্ত হোন তাহলে লাল চালের ভাত খাওয়া উচিত।
ভাতের সাথে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, মুরগির মাংস, ডিম, ডাল, এবং বাদাম খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন শিশুর সঠিক বৃদ্ধি এবং মায়ের শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন বিভিন্ন রঙের ফলমূল ও শাকসবজি অবশ্যই খাওয়া উচিত। লাল, সবুজ, এবং হলুদ রঙের সবজিতে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা মায়ের এবং শিশুর সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য, যেমন দই এবং পনির খাওয়া উচিত। এতে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি থাকে যা শিশুর হাড়ের গঠনে সহায়ক।
স্বাস্থ্যকর চর্বি, যেমন অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, এবং বাদাম খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এতে মায়ের শরীর ও স্বাস্থ্য এবং শিশুর বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যাবে।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত যাতে শরীরের সব কার্যক্রম সুষ্ঠু থাকে।
এছাড়াও যখনই আপনার ক্ষুধা লাগবে তখনই আপনি অল্প কিছু বাদাম, টকদই, পরিমিত ফল-মুল খেতে পারেন।
মনে রাখবেন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টিকর খাবার এবং গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর যত্ন একটি সুস্থ নবজাতক জন্মদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
গর্ভাবস্থায় কি কি খাওয়া যাবে না
গর্ভাবস্থায় শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এখানে কিছু খাবারের তালিকা দেওয়া হলো যা গর্ভাবস্থায় এড়িয়ে চলা উচিত:
১. কাঁচা মাছ, যেমন সুশি এবং আধা-কাঁচা মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ এতে ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী থাকতে পারে যা ক্ষতিকর হতে পারে।
২. কাঁচা বা আধা-কাঁচা ডিম এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
৩. অপরিশোধিত দুধ এবং তা থেকে তৈরি দুগ্ধজাত পণ্য এড়িয়ে চলুন, কারণ এতে লিস্টেরিয়া ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
৪. অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ এড়িয়ে চলা উচিত। প্রতিদিন ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন, যা প্রায় এক থেকে দুই কাপ কফির সমান।
৫. গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল পান এড়িয়ে চলা উচিত। এটি শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৬. কিছু সামুদ্রিক খাবারে উচ্চমাত্রায় পারদ থাকতে পারে, যা শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। যেমন শার্ক, সোর্ডফিশ, কিং ম্যাকারেল এড়িয়ে চলুন।
৭. পেঁপে এবং আনারসের মতো কিছু ফল এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে প্রিজমোলস বা এনজাইম থাকতে পারে যা গর্ভাবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৮.অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে কারণ এতে ব্লাড সুগার লেভেল বেড়ে যেতে পারে।
৯. ভাজাপোড়া খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কারণ এটি আপনার দেহে শুধু ক্যালরির মাত্রা বাড়াবে পুষ্টি নয়। এতে শিশু অপুষ্ট হবে৷
১০. চিপস, চকলেট, পেস্ট্রি, আইসক্রিম, পুডিং এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
এছাড়াও এমন কিছু খাবার আছে যা একদমই খাওয়া যাবে না। এরকম কিছু খাবার হলো:
- হারবাল বা ভেষজ ঔষধ।
- অ্যালার্জি জাতীয় খাবার।
- অপাস্তরিত দুধ।
- সসেজ, সালামি কিংবা পেপারনি খাওয়া বাদ দিতে হবে।
- ৫০-৭০ গ্রামের বেশি কলিজা খাওয়া বাদ দিতে হবে।
- মদ ইত্যাদি।
গর্ভকালীন বিপদ চিহ্ন
গর্ভকালীন বিপদ চিহ্নগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকা মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গর্ভকালীন বিপদ চিহ্ন তুলে ধরা হলো:
১. প্রচণ্ড রক্তপাত: অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক রক্তপাত গর্ভাবস্থার বিপদের সংকেত হতে পারে। এটি প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা প্লাসেন্টা অ্যাব্রাপশন ইত্যাদি সমস্যার কারণ।
২. তীব্র পেট ব্যথা: তীব্র বা স্থায়ী পেট ব্যথা জরুরি অবস্থা নির্দেশ করতে পারে। এটি গর্ভাবস্থার বিভিন্ন সমস্যা যেমন অ্যাপেন্ডিসাইটিস, ইকটোপিক প্রেগনেন্সি বা প্রি-একলামসিয়া হতে পারে।
৩. বাচ্চার কম নড়াচড়া: গর্ভের বাচ্চার নিয়মিত নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করুন। যদি আপনি মনে করেন বাচ্চার নড়াচড়া কমে গেছে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৪. অতিসংবেদনশীলতা: হাত, পা, মুখ বা চোখে অস্বাভাবিক ফোলা প্রি-একলামসিয়ার চিহ্ন হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৫. তীব্র মাথা ব্যথা ও দৃষ্টির সমস্যা: দীর্ঘস্থায়ী মাথা ব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, ঝিলিমিলি দাগ দেখা ইত্যাদি প্রি-একলামসিয়ার লক্ষণ হতে পারে।
৬. জ্বর ও ঠান্ডা লাগা: কোনো অজানা কারণে জ্বর বা ঠান্ডা লাগা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা নির্দেশ করতে পারে। তাই সচেতন হোন।
৭. অস্বাভাবিক স্রাব: যোনি থেকে অস্বাভাবিক স্রাব, স্রাবের রং, গন্ধ পরিবর্তন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এটি ইনফেকশন বা অমিনোটিক স্যাক ফেটে যাওয়ার সংকেত হতে পারে। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৮. বুকে চাপ অনুভব: বুকে তীব্র চাপ, শ্বাসকষ্ট বা হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হলে, এটি হৃদরোগের সংকেত হতে পারে।
৯. বারবার বমি: গর্ভাবস্থায় হালকা বমি স্বাভাবিক, কিন্তু বারবার বমি হলে তা ডিহাইড্রেশন এর লক্ষণ।
১০. ব্যথা ও সংক্রমণ: ইউরিনেশন বা প্রস্রাবে ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হলে তা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের (UTI) লক্ষণ হতে পারে। এমনটা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
১১. গর্ভের বাচ্চার ওজন না বাড়া: গর্ভের বাচ্চার নির্দিষ্ট সময়ে বৃদ্ধির হার কমে গেলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিৎ।
১২. হাত–পা ঝিম ঝিম করা: খুব বেশি সময় ধরে হাত বা পা ঝিম ঝিম করা বিশেষ কোনো সমস্যার কারণ হতে পারে।
১৩. চোখে ঝাপসা দেখা: অনেক সময় গর্ভাবস্থায় চোখে ঝাপসা দেখা প্রি-একলামসিয়ার লক্ষণ।
১৪. তীব্র ও নিয়মিত কোমর ব্যথা: তীব্র ও নিয়মিত কোমর ব্যথা, বিশেষ করে যদি এটি তীব্রতর হয়, তা নবজাতক জন্মের আগের মুহূর্তের সংকেত দেয়। তাই প্রস্তুত থাকুন।
সব সময় মনে রাখবেন, যেকোনো সন্দেহ বা অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার কিংবা মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন। আপনার ও আপনার শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে সচেতন থাকুন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।
শেষ কথা
গর্ভবর্তীকালীন সময়ে বিভিন্ন রকমের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। তাই এইসব অসুস্থতা রোধ করতে প্রয়োজন মেডিসিন। এবং আপনি ঘরে বসে যেকোনো প্রয়োজনীয় মেডিসিন পাবেন আরোগ্য অনলাইন ফার্মেসী থেকে। তবে যেকোনো মেডিসিন সেবন করার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। সুতরাং মা ও শিশুর যেমন গর্ভবর্তীকালীন সময়ে যত্ন নেওয়া হয় তেমন শিশু জন্মদানেও পরেও যত্ন নেওয়া উচিৎ।
FAQs
১.গর্ভাবস্থায় কোন কোন ফল খাওয়া নিষেধ?
উত্তর: এ সময় আনারস এবং পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
২.গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগার বেড়ে গেলে কি কি খেতে হবে?
উত্তর: এ সময় সাদা চালের পরিবর্তে লাল চালের ভাত, গমের রুটি, ওটস, ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে।
৩. দুধ, জাফরান খেলে কি নবজাতক ফর্সা হয়?
উত্তর: এটা একটা মিথ। এরকম কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখা পাওয়া যায়নি। সন্তানের গায়ের নির্ভর করে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের উপর।