গলা ব্যথার বিভিন্ন কারণ, উপসর্গ, লক্ষণ, চিকিৎসা, প্রতিকার, করণীয় ২০২৪ (Sore Throat Causes, Symptoms, Signs, Treatment, Remedies, What To Do)! গলায় ব্যথা সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও তা জটিল কোন রোগের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ঋতু পরিবর্তন, বহুক্ষণ কথা বলা ইত্যাদি কারণে সমস্যাটি হয়ে থাকে। চলুন গলা ব্যাথার বিভিন্ন লক্ষণ, উপসর্গ ও করণীয় বিষয়ে জেনে নিই।
গলায় ব্যথা সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অন্য কোন জটিল অসুখের পূর্ব লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ঠাণ্ডা লাগা, ঋতু পরিবর্তন, বহুক্ষণ কথা বলা ইত্যাদি কারণে যে কারও গলা ব্যাথা হতে পারে। আসুন সমস্যাটির বিভিন্ন লক্ষণ, উপসর্গ ও করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিই।
গলা ব্যথা কি?
গলা ব্যথা যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফ্যারিঞ্জাইটিস (Pharyngitis)। প্রধানত ঠান্ডা ও ফ্লু (ইনফ্লুয়েঞ্জা) এর জীবাণুর সংক্রমণে গলায় এ ধরণের সমস্যা হতে দেখা যায়। অনেক সময় গলা ব্যথার জন্য গলায় শুষ্ক চুলকানি হওয়া সহ ঢোক গিলতে, কিংবা খাবার গিলতেও সমস্যা হয়ে থাকে।
গলা ব্যথার কারণ সমূহ
গলা ব্যথার জন্য অনেকগুলো কারণ দায়ী যার মধ্যে ভাইরাসজনিত অসু্স্থ্যতা যেমন ঠান্ডা, ফ্লু, মনোনিউক্লিওসিস (Mononucleosis) অন্যতম। অন্যান্য ভাইরাসজনিত অসু্স্থ্যতা যেমন- হাম, চিকেনপক্স এর সংক্রমনেও গলা ব্যাথা হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া জনিত সংক্রমণ যেমন টনসিলের সমস্যা ও ডিপথেরিয়ার কারণেও গলা ব্যাথা হয়ে থাকে। এছাড়া অন্যান্য কারনের মধ্যে এলার্জি জনিত সমস্যা,শুষ্ক আবহাওয়া, বিশেষ করে কোন কারণে শীতকালে ঘরের তাপমাত্রা বেশি গরম হয়ে যাওয়া, ধূমপান করা, অধিক মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া, গলার মাংসপেশীতে চাপ লাগা, এইচআইভি’র সংক্রমণ, ও মদপানের কারণে গলায় টিউমার হওয়া ইত্যাদি।
গলা ব্যথার লক্ষণ সমূহ
গলা ব্যথা হলে প্রধানত নিম্নের কতিপয় লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ দেখা দেয়। যেমন-
- গলায় খসখসে ভাব, চুলকানো এমনকি গলা ফুলেও যেতে পারে।
- শ্বাস নেয়া, ঢোক গিলা কিংবা কথা বলার সময় গলায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- ঠান্ডার জন্য গলা ব্যথা হলে এর সাথে শরীরে ব্যথা সহ সর্দি, কাশি, হাঁচি ও জ্বর হতে পারে।
গলা ব্যথার বিভিন্ন উপসর্গ
গলা ব্যথা যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে তাহলে টনসিল ফুলে যাওয়া সহ নিম্নের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে। নিম্নের উপসর্গগুলো দেখা দেয়া মাত্রই ডাক্তরের কাছে গিয়ে সুচিকিৎসা নিতে হবে।
- ঢোক গিলতে বা খাবার খেতে অসুবিধা হওয়া।
- বার বার গলা ব্যথা হওয়া।
- বমি হওয়া।
- শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া।
- অতিরিক্ত মাথা ব্যথা করা।
- গলা ব্যথা মরাত্মক আকার ধারণ করা।
- গলার টনসিল ফুলে লালচে হয়ে যাওয়া।
- ৬ মাসের নীচে বয়সী শিশুদের জ্বর ১০১ ফারেনহাইট এবং বড়দের ক্ষেত্রে তা ১০৩ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে যাওয়া।
- অনেক সময় গলায় বা টনসিলে পুঁজও হতে পারে।
কাদের গলায় ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি ?
নিম্নোক্ত ব্যাক্তিদের গলায় ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
- শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা যারা ধুলা বালির সংস্পর্শে বেশি আসে।
- যারা ধূমপান কারী ব্যক্তি বা পরোক্ষ ভাবে যারা এর সংস্পর্শে আসে যেমন যারা ধূমপায়ী ব্যক্তির খুব কাছাকাছি থাকে।
- যাদের ধূলা-বালি থেকে এলার্জির সমস্যা হয়।
- যারা ঘরে ব্যবহার করা জ্বালানী ও রাসায়নিক বস্তুর সংস্পর্শে আসে।
- যাদের দীর্ঘ সময় ধরে সাইনাসের সমস্যা রয়েছে।
- যারা একসাথে গাদাগাদিভাবে থাকে যেমন-শ্রেণীকক্ষ, অফিস ইত্যাদিতে। এখানে একজনের সমস্যা হলে দ্রুত তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- এছাড়া যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদেরও এই সমস্যা বেশি হয়।
যেসব জীবন–যাপন পদ্ধতির মাধ্যমে গলা ব্যথা প্রতিরোধ করা সম্ভব
নিম্নোক্ত নিয়ম কানুন মেনে চলার মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা এই গলা ব্যাথার সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারি। যেমন-
- যতবার সম্ভব সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
- অন্যের ব্যাবহার করা খাবার ও জিনিসপত্র যেমন গ্লাস, প্লেট,গামছা,ত,কিংবা তোয়ালে শেয়ার করা বাদ দিতে হবে।
- অন্যের ব্যবহৃত টেলিফোন বা মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
- একই পানির জগ বা গ্লাস মুখ দিয়ে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- নিয়মিত টেলিফোন, টিভির রিমোট ও কম্পিউটার কী-বোর্ড পরিষ্কার করতে হবে।
- অসুস্থ ব্যক্তি থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
- বাড়ির আবহাওয়া শুষ্ক থাকলে তা আদ্র রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
- হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই পরিষ্কার রুমাল ব্যবহার করা সহ নিয়মিত তা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- ধূমপান করা কিংবা ধূমপায়ী ব্যক্তিদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে।
- প্রচুর তরল জাতীয় খাবার যেমন- গরম চা পানি ও ফলের রস খেতে হবে।
- ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা হলে এক গ্লাস গরম পানিতে আধা চা চামচ লবণ মিলিয়ে তা দিয়ে গড়গড়া করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
- ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা এক গ্লাস খুব গরম পানিতে মধু এবং লেবু মিশিয়ে তা ঠান্ডা করে তারপর পান করা যেতে পারে।
- যতটুকু সম্ভব কথা কম বলার চেষ্টা করতে হবে।
- সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে বাড়িতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
গলা ব্যথার চিকিৎসা
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গলা ব্যথা সাধারণত এক সপ্তাহ অথবা কিছুদিন পর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে যদি এর প্রকোপ বেশী হয় তাহলে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন গলা পরীক্ষা (throat culture) ও অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। রোগের ধরণ জেনে ডাক্তারের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হবে। এছাড়া পর্যাপ্ত তরল খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত ও বাড়তি ঘুমাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এ্যান্টিবায়োটিক সেবনেরও প্রয়োজন হতে পারে।
গলার সংক্রমণের চিকিৎসা:
ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ফ্যারিঞ্জাইটিস অথবা গলার সংক্রমণ ঘটে।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ: ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণের একমাত্র উপসর্গ হল গলা ব্যথা। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণের সঙ্গে আর কোনো সাধারণ ঠাণ্ডা লাগার উপসর্গ যুক্ত থাকবে না। কোনো ব্যক্তির সাদা ছোপ অথবা লালচে ভাবযুক্ত ফোলা এবং ব্যথা গলা থাকতে পারে। স্ট্রেপ্টোকক্কাস দ্বারা সংঘটিত সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের চিকিৎসা দরকার এবং আপনি খানিক ভালো বোধ করলেও এই পদ্ধতিটিকে সম্পূর্ণ করতে হবে। যে সব বাচ্চাদের স্ট্রেপ সংক্রমণ হবে, তাদের অবশ্যই এই কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে হবে। এতে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে অথবা রিউম্যাটিক জ্বর আসতে পারে, তবে এটি হবার সম্ভাবনা খুবই বিরল।
ভাইরাল সংক্রমণ: ভাইরাল সংক্রমণের কারণে গলা ব্যথা হলে কোনো চিকিৎসা হোক বা না হোক, 3 থেকে 7 দিনের মধ্যে তা কমে যায়। যদি গলা ব্যথার পাশাপাশি জ্বরঅ থাকে, তবে প্যারাসেটামল খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা একমাত্র আপনার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার পরেই করবেন। কখনো কখনো ফ্লু, সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা, হাম, গনোরিয়া, চিকেনপক্স, মনোনিউক্লিওসিস এবং ক্রুপ হলে প্রচণ্ড গলা ব্যথা হতে পারে।
গলার সংক্রমণের প্রতিরোধ
- যথেষ্ট পরিমাণ জল দিয়ে প্রায়শই নিজের হাত ধোবেন।
- নিজের মুখ স্পর্শ করবেন না।
- সংক্রমণ আটকাতে স্বাস্থ্যকর জীবনশৈলী মেনে চলুন।
- খাবার ও বাসন ভাগাভাগি করবেন না, এতে একজন ব্যক্তি থেকে আরেকজন ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়া আটকানো যেতে পারে।
কখন ডাক্তার দেখাতে যাবেন?
গলা ব্যথা সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। যদি এক সপ্তাহ পরেও উপসর্গগুলি আরো তীব্র থাকে, তবে আপনার ডাক্তার দেখানো উচিৎ।
উপসর্গগুলি হল:
- বেশী জ্বর
- অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
- খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- কানে ব্যথা
- গায়ে ফুসকুড়ি
- বারবার গলায় সংক্রমণ
- ঘাড়ে গোটা হওয়া
- দশ দিন পরেও কর্কশ আওয়াজ
চিকিৎসার সাহায্য প্রয়োজন।
যদি বাচ্চাদের শ্বাসপ্রশ্বাসে এবং গিলতে কষ্ট হয়, তবে তাদের তক্ষুণি চিকিৎসা করা উচিৎ।
গলার সংক্রমণের ব্যাপারে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন:
কী করলে গলা ব্যথা দ্রুত কমে যায়?
গলার কলাগুলির ফুলে যাওয়া কমানোর জন্য নুন জলে গার্গেল করা হচ্ছে সবচেয়ে সহজ প্রাকৃতিক টোটকা। এটি গলায় অবাঞ্ছিত ব্যাকটেরিয়াকেও মেরে ফেলে। ফোলা এবং ব্যথা কমানোর জন্য গলা ব্যথার জন্য ঘরোয়া টোটকা-কে অনুসরণ করুন।
গলা ব্যথার জন্য আপনার কখন ডাক্তার দেখাতে যাওয়া উচিৎ?
ভাইরাস ঘটিত গলা ব্যথা পাঁচ দিনের মধ্যে কমে যায়। যদি গলার সংক্রমণে ঠাণ্ডা লাগার কোনো উপসর্গ না থেকে থাকে, তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখাবেন। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা দরকার। আপনার ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করে আপনার চিকিৎসা করবেন।
কেন আমার শুধু গলা ব্যথা আছে, অন্য কোনো উপসর্গ নেই?
যদি আপনার কেবল গলা ব্যথা থেকে থাকে এবং আর অন্য কোনো উপসর্গ না থেকে থাকে, তবে এটি হয়ত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে হতে পারে।
গলা ব্যথার ক্ষেত্রে ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়াগত সংক্রমণের মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করবেন?
যদি ঠাণ্ডার অন্যান্য উপসর্গ না থাকে এবং কেবল গলা ব্যথা থাকে, তবে এটি হয়ত ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ। এর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা প্রয়োজন। ভাইরাল সংক্রমণের জন্য প্রচণ্ড গলা ব্যথার পাশাপাশি জ্বর, কাশি এবং ফ্লু হতে পারে। অ্যালার্জির কারণে গলায় সংক্রমণ হলে তা কোনো উপসর্গ দেখায় না কিন্তু অনেক দিন থাকে। গলা থেকে প্রয়োজনীয় তরল পদার্থ বার করে নিয়ে আসলে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ কিনা তা নির্ণয় করতে সুবিধা হয়।
গলাব্যথা কতক্ষণ থাকতে পারে?
ভাইরাল সংক্রমণের ক্ষেত্রে তিন-পাঁচ দিনের জন্য গলা ব্যথা থাকে এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ক্ষেত্রে দশ দিনের বেশী থাকতে পারে।
গলা ব্যথা একটি স্বাভাবিক শারীরিক সমস্যা। এই সমস্যায় কমবেশি সবাই ভুগে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে ও নানা কারণে আমাদের গলায় ব্যথা হতে পারে। তাই সাবধানে থাকা সহ সঠিকভাবে জীবন যাপন করার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা উচিত।