বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা

বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার উদ্দেশ্য, কারন ও আমাদের করণীয়

প্রত্যেকটি কাজের একটি উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্যে বিহীন কাজের কোন মূল্য নেই। বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে।
 
এর দুটি মূল উদ্দেশ্য হলোঃ
১. কোন ব্যক্তি বৈদ্যুতিক কারনে যাতে আহত বা নিহত না হয় এবং
২. বৈদ্যুতিক কারনে সৃষ্ট আগুন দ্বারা কোন সম্পত্তি যেন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় ।
 
 

আগুন ও বিদ্যুৎ একসাথে হওয়ার প্রদান দুটি কারন

 

ওভারহিটিং

বৈদ্যুতিক তারের মধ্য দিয়ে তার ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে অতিরিক্ত যে তাপের সৃষ্টি হয় তাকে ওভারহিটিং বলে।
 

আরচিং

বৈদ্যুতিক তারের দুই প্রান্তে কখন কখন যে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি দেখতে পাওয়া যায় তাকে আরচিং বলে। প্রায় সময়ই বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিট বা বিদ্যুৎ প্রবাহের বাধার কারণে আরচিং ঘটে।
 
 

বৈদ্যুতিক দূর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের কারন সমূহ – Causes Of Electric Fires

বৈদ্যুতিক দূর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের প্রধান প্রধান কারনগুলো হলোঃ
● বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সঠিকভাবে স্থাপন না করা,
● বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষন না করা,
● নিন্মমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা,
● বিল্ডিং কোড না মেনে বিল্ডিং নির্মান করা,
● বৈদ্যুতিক নকশা ব্যবহার না করা,
● সঠিক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা না থাকা,
● বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষনে অযোগ্য লোক নির্বাচন,
● লোড হিসেব না করে যত্রতত্র বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার,
● পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার না করা,
● গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সঠিক ও নিরাপদ স্থানে স্থাপন না করা,
● বিপদজনক ও ভারী বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপনে আলাদা জায়গা ব্যবহার না করা।
 

 

বৈদ্যুতিক দূর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে করনীয় – To Prevent Electrical Accidents and Firefighters

বৈদ্যুতিক দূর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সুরক্ষা ব্যবস্থা, বিভিন্ন কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ ও সচেতনতা।
 
নিচে বিভিন্ন ধাপে তা আলোচনা করা হলো।
 বৈদ্যুতিক নকশা তৈরি করে নিতে হবে,
 ওভারলোডিং এড়িয়ে চলা,
 অনুপযুক্ত স্থানে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপন,
 আর্থিং সিস্টেম ব্যবহার করা,
 জরুরী বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা,
 রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিদর্শন ।
 
 

বৈদ্যুতিক নকশা তৈরি করে নিতে হবে

মানসম্মত নিরাপদ ভবন নির্মানে লাইসেন্সপ্রাপ্ত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী দ্বারা বৈদ্যুতিক নকশা তৈরি করে নিতে হবে। অনুপযুক্ত নকশার কারনে আমাদের দেশের বহু উঁচু ভবনের এখন বজ্রপাত প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা নেই। বিল্ডিং কোড অনুসরন না করে ভবন নির্মানের ফলে যত্রতত্র বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়।
 
বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম রক্ষায় আধুনিক কোন ডিভাইস স্থাপন করা হয় না। এর ফলে বিভিন্ন সময় ছোট-বড় দূর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়ে থাকে। তাই নতুন ভবন অথবা বিদ্যমান ভবনকে কি ভাবে নিরাপদ ভবনে উন্নতি করা যায় এ জন্য প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর নিকট থেকে বৈদ্যুতিক নকশা তৈরি করে নিতে হবে।
 
 

ওভারলোডিং এড়িয়ে চলা

যখন একই আউটলেটে অধিক পরিমান বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয় তখন ওভারলোডেড হয়ে আউটলেট বা সার্কিট অত্যধিক তাপ উৎপন্ন করে যা বৈদ্যুতিক আগুনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনার সময় এতে অভ্যন্তরীণ ওভারলোড প্রোটেকশান আছে কিনা আমরা তা দেখি না। অবশ্যই ভালো করে তা দেখে নিতে হবে।
 
পুরোনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পরির্বতন না করে অনবরত তা ব্যবহার করা ও অনুমোদিত ওয়াটের অধিক ওয়াটের লাইট ব্যবহার করার ফলে বিভিন্ন দূর্ঘটনা হয়। ওভারলোডিং এড়িয়ে চলতে আমাদের এসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
 
 

অনুপযুক্ত স্থানে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্থাপন

অপেক্ষাকৃত ভারী, বিপদজনক ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির জন্য যায়গা অথবা আলাদা রুম নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। অন্যথায় অনুপযুক্ত স্থানে এসব যন্ত্রপাতি স্থাপনের ফলে বৈদ্যুতিক দূর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ড সংগঠিত হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছেঃ
 
এনার্জি মিটারঃ এর রিডিং নেয়ার স্থানে গ্লাস উইন্ডো ব্যতিত সকল অংশে প্রোটেক্টিভ কভার ব্যবহার করতে হবে। এটি ভূমি হতে ১ মিটারের অধিক উচ্চতায় ইনস্টল করতে হবে।
 
সাব-স্টেশনঃ বহুতল ভবনের সর্বনিন্ম তলায় সাব-স্টেশন স্থাপন করা উত্তম। সাবস্টেশন বা সুইচরুমের মেঝে সর্বোচ্চ বন্যা স্তরের লেভেলের উপরে থাকতে হবে। এর নূন্যতম উচ্চতা ৩.৬ মিটার হবে। ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যার পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
 
বাংলাদেশের ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নিয়ম অনুসারে ভবনের লোড 50KW এর বেশি হলে সেখানে সাবস্টেশন 11KV/0.4KV প্রয়োজন। এ রুম অবশ্যই পানি, তেল, দাহ্য পদার্থ, ধ্বংসাবশেষ, ময়লা ও সকল বাঁধা থেকে মুক্ত হতে হবে। পর্যাপ্ত সিঁড়ি ও মুক্ত আলো চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ রুমে প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম ও অগ্নি সুরক্ষা থাকা আবশ্যক।
 
ট্রান্সফরমারঃ ট্রান্সফরমার কোন ভাবেই দাহ্য বস্তুর বেসের উপর বসানো যাবে না। এটি অবশ্যই ধুলো ময়লা ও দাহ্য বস্তু থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ট্রান্সফরমারের তেল জাতীয় সামগ্রী যদি ২০০০ লিটারের বেশি হয় তবে অবশ্যই নিষ্কাশণ কূপের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ট্রান্সফরমারের ব্রেদারস এর তেলের কাপ সব সময় পূর্ণ থাকতে হবে। উপযুক্ত বেড়া ও পর্যাপ্ত আর্থিং সিস্টেম থাকতে হবে।
 
বয়লারঃ বয়লার আলাদা একটি রুমে স্থাপন করতে হবে ও নিশ্চিত হতে হবে সে রুমে স্বয়ংক্রিয় অগ্নি দমন পদ্ধতি ইনস্টল রয়েছে। এছাড়াও বয়লার রুমে কিকাআউট প্যানাল স্থাপন করে বড় ধরনের দূর্ঘটনা রোধ করা যায়। বয়লারে কাজ শুরু করার পূর্বে বয়লারের চিফ ইন্সপেক্টর থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে হবে।
 
 

সকল প্রকার বোর্ড, বক্স ও অন্যান্য ডিভাইস

ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড বা সুইচ বোর্ড এর কাছাকাছি ও এর ভিতরে কোন দাহ্য পদার্থ, ধুলো-বালি ও ময়লা থাকতে পারবে না। ওভারলোডিং, ওভারহিটিং বা বারনিং প্রতীকের নির্দেশিকা থাকতে হবে। প্রতিটি সার্কিটে পর্যাপ্ত ইসিসি ও ডেডিকেটেড নিউট্রাল থাকতে হবে। সকল তারের কালার কোড ঠিক রাখতে হবে।
 
টার্মিনাল ও সার্কিট ব্রেকারের মধ্যে ফেজ বিভাজন করতে হবে। বৈদ্যুতিক তার ও কনডুইট সঠিকভাবে অনুমোদিত হতে হবে। ২০ মি. উচু ভবনের জন্য যেখানে মেঝে ১৫০০ বর্গমি. সেখানে সর্বনিন্ম ২০০ মিমি, ৪০০ মিমি আকারের উলম্ব শ্যাফট চূড়া থাকবে। সকল প্রকার ধাতব বস্তুতে আর্থিং অথবা গ্রান্ডিং এর সংযোগ স্থাপন করতে হবে।
 
কোন তার খোলা অবস্থায় রাখা যাবে না, ক্যাবল জয়েন্টগুলো বক্সে রাখার পূর্বে চীনামাটি বা পিভিসি কানেকটর পিআইভি টেপ দিয়ে দিতে হবে। বৈদ্যুতিক কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতগুলো উন্নত মানের হবে ও এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য রাবার ম্যাট রাখতে হবে। ০.৩৭৬ কিলো ওয়াটের উপরের সকল মটরে ওভারলোড প্রোটেকশন থাকবে। লাইট ও ফ্যান সংযোগের জন্য সিলিং রোস ব্যবহার করতে হবে।
 
 

আর্থিং সিস্টেম ব্যবহার করা

যে পদ্ধতিতে সকল প্রকার ধাতব বস্তুকে মাটির নিচে স্থাপিত আর্থ ইলেকট্রোডের সাথে সংযুক্ত আর্থ কন্টিনিউটি কন্ডাক্ট্রোরস (Earth Continuity Conductors) এর সাথে যুক্ত থাকে তাকে আর্থিং সিস্টেম বলে। এর সাথে ফিউস বা সার্কিট বেকার যুক্ত হয়ে প্রটেক্টিভ সিস্টেম হিসেবে কাজ করে।
 
যে সকল আর্থিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়ে থাকেঃ
 সাবস্টেশন ন্যাচারাল আর্থিং (Substation Neutral Earthing)
 সাবস্টেশন এলটি সিস্টেম আর্থিং (Substation LT System Earthing)
 ইকুয়েপম্যান্ট আর্থিং সিস্টেম (Equipment Earthing System)
 এইচটি সার্কিট আর্থিং (H. T. Circuit Earthing)
 এলটি সার্কিট সিস্টেম আর্থিং (L. T. Circuit System Earthing)
 
 

জরুরী বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা

যে কোন ভবনের বিদ্যুৎ প্রবাহ বিঘ্নিত হলে তা জানমাল, সম্পত্তি, উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যহত সহ বিভিন্ন ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়, তাই ভবনে অবশ্যই জরুরী বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকতে হবে।
 
কোথায় কেমন জরুরী বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা দরকার তা নিচে আলোচনা করা হলোঃ
 

জেনারেটর

জেনারেটর অবশ্যই মূল ভবনের বাহিরে সাবস্টেশন বিল্ডিং এ এবং এর মাত্রারিক্ত কম্পন ও উচ্চ মাত্রার শব্দ এড়ানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। জেনারেটরের লোড সঠিকভাবে হিসেব করে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এ রুমে যেন পানি প্রবেশ করতে না পারে তা লক্ষ্য রাখতে হবে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
 
জেনারেটার রুমে ফায়ারফাইটিং ইকুউপম্যান্ট ও ফার্স্ট এইড বক্স রাখতে হবে। সহজে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে ও এর সিঁড়িতে ধাতব পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না।
 

রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিদর্শন

বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির জন্য ইন্সপেকশন ও টেস্টটিং এর রেকর্ড বই রাখতে হবে। নতুন কোন যন্ত্র ইন্সটল করার পর পুনরায় তা চেক করতে হবে। রেটিং ও লোডিং এর মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে সকল প্রকার বোর্ড ও সুইচগেয়ার প্রতি বছর ১ বার চেক করতে হবে।
 
নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর সাবস্টেশন, জেনারেটর রুম সহ সকল মিটার গুলোর বৈধতা পরিক্ষা করতে হবে। ৩% এর উপরে মিটারিং এরোর গ্রহনযোগ্য নয়। আর্থ রেশিস্ট্যান্সের ক্ষেত্রে তার মান ১ ওহোমের বেশি হতে পারবে না।
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button