দুর্যোগ থেকে নিরাপত্তা

ভয়াবহ সকল দুর্যোগসমূহ ও তাসৃষ্ট কারণ [যা না জানলেই নয়]

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারনে ভয়াবহ সকল দুর্যোগসমূহ – All Natural and Man-made Disasters

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দু কারনেই দুর্যোগ সংগঠিত হতে পারে তবে প্রাকৃতিক কারনেই অধিকাংশ দুর্যোগ ঘটে থাকে।
 
প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট এ দুটির মধ্যে যে কয়টি দুর্যোগ বড় ধরনের বিপদ বয়ে আনে ও প্রায় প্রতি বছর সংগঠিত হয় সে গুলো হলোঃ
১. ভূমিকম্প (Earthquake)
২. ভবনধ্বস (Collapse/Structure Failure)
৩. অগ্নিকান্ড (Fire)
৪. বজ্রপাত (Thunder)
৫. বন্যা (Flood)
 
 

ভূমিকম্প

ভূ-অভ্যন্তরে দীর্ঘ সময়ে জমানো চাপ, তাপ ও বিক্রিয়ায় কারনে সৃষ্ট শক্তির হঠাৎ বিমুক্তির ফলে ভূপৃষ্ঠে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকে ভূমিকম্প বলে। এ ধরনের কম্পন মৃদু, মাঝারি বা প্রচন্ড হতে পারে। এটি সাধারনত কয়েক সেকেন্ড থেকে ২-৩ মিনিট স্থায়ী হতে পারে। পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬,০০০ ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই মৃদু আকারের হয় বলে আমরা তা বুঝতে পারি না। শক্তিশালী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে ও প্রাণহানি হয়।
 
যে সকল কারনে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে সেগুলো হলোঃ
  • ভূপৃষ্ঠের প্লেটসমূহের মধ্যে পারস্প্ররিক ধাক্কা,
  • ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানে শিলাচুৎতি ঘটলে,
  • ভূ-অভ্যন্তরের গলিত গ্যাস বা লাভার প্রবল ধাক্কা,
  • আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে মানবসৃষ্ট কারনে।
 
 
এসব ভূমিকম্পের ফলে যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয় তা নিন্মরূপঃ
 ঘরবাড়ি, ধনসম্পদ নষ্ট সহ এবং যাতায়াত ব্যবস্থা অকেজ হয়ে পড়ে,
 বিভিন্ন ভবন ও ঘরবাড়ির নিচে বহু মানুষ আটকা পড়ে ও মারা যায়,
 গবাদি পশু হাস-মুরগী সহ অন্যান্য পশু-প্রানী মৃত্যুবরণ করে,
 বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ধ্বসে যায়,
 গ্যাস পাইপ লাইন ও রাসায়নিক পদার্থে বিস্ফোরণ ঘটে,
 সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাস তৈরি হয়,
 পুকুর ও নদী-নালা শুকিয়ে যায়,
 গাছপালা নষ্ট হয় ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়,
 বহু যানবাহন নষ্ট হয়ে জরুরী পরিবহন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়,
 অনেক সময় মহামারী ও দুর্ভিক্ষে বহু লোক মারা যায়,
 বৈদুতিক শর্টসার্কিট ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের কারনে আগুন লেগে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়।
 
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে যে ভবন নির্মাণ আইন না মানা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অবহেলা ও নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বেশি হওয়ার মূল কারন। এছাড়াও যে সকল কারন গুলো রয়েছে সেগুলো হলোঃ
● ভবন নির্মাণ নিয়ম না মেনে ভবন তৈরি করা,
● ভূমিকম্প সহনশীল রড ও নিন্ম মানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা,
● ঘন বসতি ও অধিক জনসংখ্যা,
● অদক্ষ প্রকৌশলী ও মিস্ত্রি ব্যবহার করা,
● নদী, পুকুর বা ডোবা ভালো ভাবে ভরাট না করে ভবন নির্মাণ,
● মাটি পরিক্ষা না করেই ভবন নির্মাণ,
● পরিকল্পনা বিহীন ভবন ও রাস্তা নির্মান ইত্যাদি।
 
 

ভবনধ্বস

বিল্ডিংকোড ও ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ, নীচু জমি ভরাট করে ভবন মির্মাণ, পরিকল্পনা ছাড়া যত্রতত্র ইচ্ছেমত বিল্ডিং তৈরি, নির্মাণ ত্রুটি ও নিন্ম মানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের ফলে ভবনধ্বস হয়ে থাকে। ভবনধ্বস বা কাঠামোগত ধ্বসের মূল কারণ হলো মানবসৃষ্ট কারণ। তবে মানবসৃষ্ট কারন ছাড়াও ভূমিকম্পের কারণে ভবনধ্বস বা কাঠামোগত ধ্বস সংগঠিত হতে পারে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রানা প্লাজার ধ্বস কে ভবনধ্বস বা কাঠামোগত ধ্বসের প্রধান উদাহরন হিসেবে উল্যেখ করা যায়।
 
বিভিন্ন কারনে ভবনধ্বস বা কাঠামোগতধ্বস হতে পারে, তা নিচে দেয়া হলোঃ
● ভূমিকম্পের কারণে ভবনধ্বস বা কাঠামোগত ধ্বস হতে পারে,
● বিল্ডিং এর ডিজাইন ও কাঠামোগত দুর্বলতা দূর্ঘনার অন্যতম কারন,
● অবিজ্ঞ প্রকৌশলী ও দক্ষ মিস্ত্রি না রাখা, রাখলেও তদারকির অভাব থাকলে,
● বিল্ডিং নরম মাটি ও নীচু জমিতে নির্মানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভীত ও পর্যাপ্ত পাইলিং না থাকা,
● পাহারের তলদেশে ভবন নির্মান করার ফলে কখনো পাহার হেলে পরা বা কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ে ভবনধ্বস ইত্যাদি।
 
 

অগ্নিকান্ড

পরিমিত তাপের উপস্থিতিতে দাহ্যবস্তুর সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ার ফলে আগুনের সৃষ্টি হয়। আগুন আমাদের জীবনে আশীর্বাদ স্বরুপ কিন্তু তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ফলে অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়। প্রতিনিয়ত অগ্নিকান্ডের ফলে বহু প্রাণহানী ও ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি সংগঠিত হচ্ছে।
 
অগ্নিকান্ডের কারন গুলো হলোঃ
● যন্ত্রাংশের ঘষর্ণ,
● যত্রতত্র ধূমপান,
● অনিরাপদ ওয়েল্ডিং,
● অতিরিক্ত তাপমাত্রা,
● ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ ফিটিংস,
● গ্যাস ও বয়লার বিস্ফোরন,
● জ্বলন্ত বস্তু ও জ্বলন্ত গ্যাসের চুলা,
● অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সংযোগ
● ক্যামিকেলের অনিরাপদ ব্যবহার ও সংরক্ষণ,
● ভূমিকম্পের কারনে বিদ্যুৎ বা গ্যাস লাইন থেকে আগুন লাগতে পারে ইত্যাদি।
 
 

বজ্রপাত

বজ্রপাত কেন সংগঠিত হয় তার সঠিক কোন ব্যাখ্যা নেই। ধারনা করা হয় উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বজ্রপাতে সৃষ্টি হয়। বজ্রমেঘের ভেতরে বাতাসের দ্রুতগতির আলোড়নের ফলে জলীয়বাষ্পে একই সময়ে একই সাথে শিশির বিন্দু, বৃষ্টিকণা, ও তুষারকণার তৈরি হয়।
 
উক্ত বৃষ্টিকণা এবং তুষারকণার সংঘর্ষে স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়। সম্পূর্ণ ঘটনাটি বিশাল মেঘামালার মধ্যে ঘটে বলে এর ফ্রিকোয়েন্সি, পরিমান ও সৃষ্ট শব্দের পরিমান অনেক বেশি হয়। এ বিদ্যুৎ প্রায় ৩০,০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ উৎপাদন করে বিধায় এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বেশি হয়।
 
 

বন্যা

বর্ষাকালে কোন এলাকা প্লাবিত হয়ে যদি তা দীর্ঘ সময় মানুষের জীবন এবং সম্পদের ক্ষতি সাধন করে তবে তাকে বন্যা বলা হয়। আমাদের দেশে রয়েছে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী সহ মোট ৭০০টি নদী এবং বার্ষরিক বৃষ্টিপাতের পরিমান ২৩০০ মি.মি. ।
 
এজন্য বলা হয়ে থাকে “বাংলাদেশ নদীমাতৃক ও বৃষ্টিবহুল দেশ”। প্রতি বছর প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কি.মি. অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখন্ড বন্যা কবলিত হয়। ব্যপকভাবে বন্যা হলে তা ৫৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আমাদের দেশের বন্যাকে তিন শ্রেনীতে ভাগ করা যায়।
 
যথা – ১. মৌসুমি বন্যা (Monsoon Flood) ২. আকস্মিক বন্যা (Flash Flood) এবং ৩. জোয়ারসৃষ্ট বন্যা (Tidal Flood)
 
এ সকল বন্যায় মানুষ ও পশুপাখির প্রাণহানী ঘটে ও বিপন্ন হয়। তাছাড়া ফসলী জমি ডুবে যাবার ফলে বিপুল পরিমান ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে। সাধারনত মে থেকে অক্টোবর এ সময়ে বন্যা সংগটিত হয় এবং এর উচ্চতা ৩ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
 
বন্যা সংঘটিত হবার কারণগুলো হলোঃ
● দেশের ভেতরে ও দেশের বাহিরে উজান এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাত,
● ভূমিকম্প ও ভূরূপতত্ত্বে পরিবর্তন সম্পর্কিত জটিলতা,
● ভৌগলিক অবস্থান ও মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব,
● হিমালয়ের বড়ফ গলা পানির প্রবাহ,
● গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া,
● অপরিকল্পিত নগরায়ণ,
● প্রকৃতির উপর মানুষের হস্তক্ষেপ,
● বঙ্গোপসাগরের তীব্র জোয়ার-ভাটা,
● শাখানদীগুলো পলি দ্বারা ভরে যাওয়া ও তার পার্শ্বদেশ দখল হয়ে যাওয়া,
● গঙ্গা নদীতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ ও অন্যান্য নদীতে নির্মিত বাঁধের প্রভাব,
● প্রধান নদীগুলোর একিসাথে পানি বৃদ্ধি ও এক নদীর উপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি।
 
 
উপরোক্ত বড় দুর্যোগ ছাড়াও আরো কিছু দুর্যোগ রয়েছে যেগুলো প্রায়ই আমাদের বিপদে ফেলে। এর মধ্যে রয়েছে – ঘূর্ণিঝড়, খরা, নদীভাঙন ও সুনামি।
 
ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণ হলো সমুদ্রে সৃষ্ট নিন্মচাপ, বায়ুমন্ডলে বাতাসের গতিবেগ এক হওয়া, সমুদ্রের উত্তাপ তাপমাত্রা প্রভৃতি। অনাবৃষ্টি, বৃক্ষ নিধন, ভূগভস্থ পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়া ইত্যাদি কারনে খরার সৃষ্টি হয়। নদীভাঙনের কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বৃক্ষ নিধন, রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি, নদী গর্ভে ফাটল প্রভৃতি। সুনামি হয়ে থাকে ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্নুপাতের কারণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button