দুর্যোগ থেকে নিরাপত্তা

দুর্যোগ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা ও ধারণা

দুর্যোগ কি? – What is the Disaster?

সাধারন ভাবে দুর্যোগ বলতে বুঝায় এমন অবস্থা বা পরিস্থিতি যা মানুষের মন্দ বা অকল্যাণকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। দুর্যোগ মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দু ধরনেরই হতে পারে। কারন যাই হোক এ দুর্যোগ চলমান জীবন ও সমাজ কে ব্যাহত করে এবং মানুষ, সম্পদ ও পরিবেশের মারাত্নক ক্ষতি সাধন করে। বেশির ভাগ সময় এ অবস্থা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না। তারপরেও এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমাদের দরকার প্রতিরোধ ও করনীয় সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান। দুর্যোগের সাথে তিনটি শব্দ জড়িত। তা হলোঃ আপদ (Hazard), বিপদাপন্নতা (Vulnerability) ও ঝুঁকি (Risk)।
 
 

আপদ কি? – What is the Nuisance?

আপদ বা বিপদ একটি অস্বাভাবিক ঘটনা যা প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট বা কারিগরি ত্রুটির কারনে হতে পারে এবং তা সমাজ, জীবন ও জীবিকার ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করতে পারে। যেমনঃ প্রাকৃতিক আপদ (বন্যা, সুনামি, সাইক্লোন, সুনামি, নদী ভাঙ্গন ইত্যাদি) ও কারিগরি আপদ (পারমানবিক বোমা)। আপদ কোন দূর্ঘটনা নয়, দুর্যোগের সম্ভাব্য কারন। অনেক ক্ষেত্রে এর ফলাফল পূর্ব থেকে অনুমান করা যায়।
 
 

বিপদাপন্নতা কি? – What is the Vulnerability?

কোন জনগোষ্ঠির বা তার অংশের কোন এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট আপদের মাধ্যমে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা ও উক্ত আপদ ঘটার ফলে সামাজিক ও ব্যক্তির জীবনযপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য মাত্রাকে বিপদাপন্নতা বলে। বিপদাপন্নতা বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমনঃ বস্তুগত, সামাজিক, রাজনৈতিক অথবা দৃষ্টিভঙ্গিগত। বিপদাপন্নতা কে নিচের সূত্র দ্বারা প্রকাশ করা হয়ঃ
Vulnerability = People + Condition + Place + Time + Event
নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠি সমাজের সবচেয়ে বিপদাপন্ন অংশ ও যেকোন দুর্যোগে এরাই সবার আগে ও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
 
 

ঝুঁকি কি? – What is the Risk?

ঝুঁকি অর্থ আপদ, বিপদাপন্নতা ও পরিবেশের সম্মিলিত ও সক্ষমতার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য মাত্রা বা অবস্থা। ঝুঁকির সাথে তিনটি বিষয় জড়িত, সেগুলো হলোঃ আপদ (Hazard), বিপদাপন্নতা (Vulnerability) ও সক্ষমতা (Capacity)। কখনো ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করে ব্যক্তির বিপদাপন্নতা এবং সক্ষমতার মাত্রার উপর। ঝুঁকিকে নিন্মক্তো সূত্র দ্বারা প্রকাশ করা হয়ঃ
Risk = (Hazard x Vulnerability) / Capacity
আপদের ফলাফলকে কেঊ যদি তার সক্ষমতার মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তবে তার নিকট বিষটির আর কোন ঝুঁকি থাকবে না।
 
 

সামর্থ্য বা সক্ষমতা কি? – What is Capability?

সক্ষমতা হলো আগাম প্রস্ততি বা পূর্ব প্রস্ততি গ্রহণ করার মতো দক্ষতা বা জ্ঞান। যেমনঃ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্প সহনশীল বিল্ডিং অ মজবুত ঘর নির্মাণ করা। দুর্যোগ মোকাবেলার দক্ষতাকে একজন ব্যক্ত্যির সক্ষমতা বলা যেতে পারে। সামর্থ্য হলো কাল্পনিক বা সত্যিকার কোন দুর্যোগ প্রণীত জনগোষ্ঠির ইতিবাচক পদ্ধতিতে সাড়া দেয়ার সার্বিক সক্ষমতা।
 
 

জলবায়ু কি? – What is Climate?

একটি নির্দিষ্ট স্থানের দীর্ঘ সময়ের দৈনন্দিন আবহাওয়ার সাধারণ অবস্থা বা স্বল্প কয়েক দিকের গড় ফলকে জলবায়ু বলে। নির্দিষ্ট স্থানের বায়ুমন্ডলের উপাদানসমূহের স্বল্প কয়েক দিকের গড় (যেমনঃ ১ থেকে ৭ দিনের গড়) ফলকে আবহাওয়া বলে। বায়ুমন্ডলের উপাদান বলতে বুঝায় বায়ুর আর্দ্রতা, বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ু প্রবাহের দিক ও তার গতি, মেঘের পরিমান, প্রকারভেদ ও বৃষ্টিপাত।
 
 

জলবায়ু পরিবর্তন কি? – What is Climate Change?

পৃথিবীতে সকল শক্তির মূল উৎস হলো সূর্যের আলো এবং তাপ। এ আলো ও তাপ পৃথিবীর সকল প্রাণীর জীবনধারণে সাহায্য করে। প্রতিদিন পৃথিবীতে যে সূর্যের আলো পৌঁছায় ভূপৃষ্ঠ তা শোষণ করে, এ শোষিত সূর্যকিরণ আবার বিকিরিত বা প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায় এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এই প্রাকৃতিক নিয়মে কোন বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলেই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে।
 
 

অপসারন বা স্থানান্তর কি? – What is the Removal or Transfer?

জনগনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থাই হলো অপসারণ বা স্থানান্তর। যেমনঃ অগ্নিকান্ডের সময় জনগনকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা। যখন কোন নির্ধারিত মাত্রার দুর্যোগের সতর্কতা প্রদান করা হয়, তখন বিপদাপন্ন মানুষদেরকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করা জরুরী।
 
 

অনুসন্ধান ও উদ্ধার কি? – What is Search and Rescue?

যে কোন দুর্যোগে আটকে পড়া ও হারিয়ে যাওয়া মানুষদের অনুসন্ধান ও উদ্ধার বা মুক্ত করা প্রয়োজন। যেমনঃ ভূমিকম্পের সময় ধ্বসে পড়া ভবনের নচে বা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সময় হারিয়া যাওয়া মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে পারে না, এ অবস্থায় তাদের অনুসন্ধান ও উদ্ধার করার প্রয়োজন পড়ে।
 
 

দ্রুত পুনরুদ্ধার কি? – What is Fast Recovery?

দুর্যোগ সংঘঠিত হওয়ার পর দুর্যোগ পরবর্তী সাড়াদান বা ত্রান তৎপরতা পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ধরনের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াই হলো মূলত দ্রুত পুনরুদ্ধার। দ্রুত পুনরুদ্ধার এবং ত্রান তৎপরতা উভয়ের উদ্দেশ্য একই। ব্যপক অর্থে দ্রুত পুনরুদ্ধার বলতে বুঝায় বাস্তুহারা জনগোষ্ঠির পুনঃসম্নিতকরণ জীবন-জীবিকা, আশ্রয়, পুনর্গঠন, সংষ্কার প্রভৃতি।
 
 

সাড়াদান কি? – What is the Response?

সাড়াদান বলতে বুঝায় দুর্যোগের পূর্বে, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগের পরে জীবন ও সম্পদ রক্ষা, ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠির মৌলিক চাহিদা পূরণ, জরুরী ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানে গৃহীত পদক্ষেপ।
 
 

সেবা কি? – What is the Service?

সেবা বলতে বুঝায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত কোন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা ব্যক্তি হতে প্রদেয় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা, বস্ত্র, পয়ঃনিষ্কাশন, টেলিযোগাযোগ, উদ্ধার, অনুসন্ধান, নিরাপত্তা, অগ্নি নির্বাপক সামগ্রী ও সরকার কর্তৃক অন্যান্য সেবা সমূহ।
 
 

দুর্যোগের প্রকারভেদ – Types of disasters

দুর্যোগ সৃষ্টির ধরন অনুসারে দুর্যোগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural Disaster)
২. মানবসৃষ্ট দুর্যোগ (Man-made Disaster)
 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

প্রাকৃতিকভাবে যে দুর্যোগের সৃষ্টি হয় তাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পেছনে সরাসরি মানুষের কোন হাত থাকে না। যেমনঃ ভূমিকম্প, খরা, বন্যা ইত্যাদি। এ ধরনের দুর্যোগ জীবন ও সম্পদের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব ও বিস্তার সকল দেশে সমান নয়। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষমতা কম হওয়ার কারনে জীবন এবং সম্পদহানির পরিমান অনেক বেশি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পিছনে যেসব বিষয় দায়ী যেগুলো হলোঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদি।
 

মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হলো মানুষের কাজ বা আলস্যের দ্বারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সৃষ্ট দুর্যোগ। অর্থাৎ মানুষের ভুলভ্রান্তি ও অবহেলার ফলে যে দুর্যোগের উৎপত্তি হয় তাকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বলে। যেমনঃ বন উজাড়, অগ্নিকান্ড, যুদ্ধ ও সন্ত্রাস, বিস্ফোরণ, ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button