অগ্নি নিরাপত্তা

অগ্নি মহড়া বা ফায়ার ড্রিল কি? ইহা কেন আবশ্যক? কার্যপ্রনালী ও আইনসমূহ

অগ্নি মহড়া বা ফায়ার ড্রিল কি? – What is Fire Drill Training?

অগ্নিকান্ড বা যেকোন জরুরী অবস্থায় ভবন হতে কি ভাবে নিরাপদে বের হয়ে আসা যায় এ সম্পর্কে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাকেই অগ্নি মহড়া বা ফায়ার ড্রিল বলে। পরিবারের সকলকে ও একটি কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিক/কর্মকর্তার ১৮% লোক কে অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হতে হবে। অগ্নি মহড়া দু ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ ঘোষনার মাধ্যমে ও ঘোষনা বিহীন।
 
 
 

অগ্নি মহরা কেন আবশ্যক? – Why Fire Drills are Important?

যে কোন সময় অগ্নিকান্ড সংগঠিত হতে পারে। তাই জানা থাকতে হবে কোথায় কি অগ্নি নির্বাপক উপস্থিত রয়েছে, তাৎক্ষনিক কোনটি কোন ধরনের আগুনে ব্যবহার করে সফল ভাবে আগুন নেভানো যাবে, তাৎক্ষনিক কি কি করতে হবে, যারা আহত হয়েছে তাদের কিভাবে উদ্ধার করতে হবে এবং আহত ব্যক্তিদের কিভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবেন। পর্যাপ্ত অগ্নি মহরা ছাড়া আপনি এগুলো জানতে পারবেন না।
 
 
বিষয়টি একটি উদাহরণের মাধ্যমে আরো পরিষ্কার করা যাকঃ
ধরুন আপনি পাঁচ তলা বিশিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। হঠাৎ তৃতীয় তলায় অগ্নিকান্ড সংগঠিত হলো। আগুন সমস্ত ভবনে ছড়িয়ে পড়তে ৩০মিনিট বা তার বেশি সময় লাগতে পারে কিন্তু আপনি তা জানেন না। ইক্সটিঙ্গউইসার/পানি/বালি কি ব্যবহার করা উচিত, কোথার রাখা আছে জানেন না বা ভুলে গেছেন। তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে আপনার কি অবস্থা হতে পারে সে সর্ম্পকে ধরনা নেই। তাহলে এখন আপনার কি অবস্থা আপনি নিজেই একবার চিন্তা করুন।
 
 
হ্যাঁ, পর্যাপ্ত অগ্নি মহরার জ্ঞানের অভাবে আপনার অবস্থা করুন। আপনি বড় রকমের আহত হতে পারেন বা প্রানহানির মত ঘটনাও ঘটতে পারে। এখানে ফায়ার ড্রিল আপনাকে কি কি শিখাবেঃ
  • আগুন লাগলে আপনার তাৎক্ষনিক কি করনীয়,
  • নির্দিষ্ট কোন তলায় আগুন লাগলে পর্যায়ক্রমে কোন কোন তলার লোক বের হয়ে আসবে,
  • কিভাবে নিরাপদে বের হতে হবে এবং কোথায় এসে মিলিত হতে হবে,
  • পুনঃ পুনঃ অগ্নি মহড়ায় অংশ নেয়ার ফলে কোথায় কীরূপ অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম আছে সে সর্ম্পকে পরিষ্কার ধারনা,
  • অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম সমূহের প্রয়োগ পদ্ধতি,
  • আটকা পড়লে কি করবেন,
  • আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার প্রক্রিয়া,
  • আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসাদান পদ্ধতি,
  • এ সর্ম্পকিত আইন ও বিধান সমূহ ও অন্যান্য বিষয়।
 
নিয়মিত ফায়ার ড্রিল অনুষ্ঠিত হলে দুর্ঘনাকালীন সময়ে সকলে তাদের করনীয় সর্ম্পকে অবহিত থাকবে এবং প্রানহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক কম হবে।
 
 
 

অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর কার্যপ্রনালী – Firefighter Procedures

সুষ্ঠ ভাবে অগ্নি নির্বাপণ, উদ্ধারকার্য পরিচালনা ও আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দানের লক্ষ্যে অগ্নি নির্বাপক দলকে তিন ভাবে বাগ করা হয়েছে। যথাঃ
১. অগ্নি নির্বাপক দল (Firefighters)
২. উদ্ধারকারী দল (Rescue team)
৩. প্রাথমিক চিকিৎসা দল (First aid team)
 
 

অগ্নি নির্বাপক দল

অগ্নি নির্বাপক দল হলুদ রং এর এপ্রোণ পড়ে, তার পিছনে লাল রং দিয়ে “আগুন” (Fire) লিখা থাকে। প্রাথমিক ভাবে আগুন নিভানোর দলকে অগ্নি নির্বাপক দল বা ফায়ার ফাইটার টিম বলে। ফায়ার ফাইটার টিম নিন্মক্তো কাজগুলো করে থাকেঃ
● বিপদ সংকেত বা ঘন্টা বাজিয়ে সকলকে সতর্ক করা,
● বৈদ্যুতিক মূল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা,
● আগুনের উৎস স্থলের পার্শ্ববর্তী মালপত্র অন্য স্থানে সরিয়ে ফেলা,
● অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রদ্বারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করা,
● প্রয়োজনে পানির পাম্প বা মোটর চালু করার ব্যবস্থা নেয়া,
● প্রয়োজন অনুসারে বিটার, ফায়ার হুক, হোস পাইপ ইত্যাদি অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম ব্যবহার করা।
 

 

উদ্ধারকারী দল

উদ্ধারকারী দল হলুদ রং এর এপ্রোণ পড়ে, তার পিছনে লাল রং দিয়ে “উদ্ধার” (Rescue) লিখা থাকে। অগ্নিকান্ডের সময় আহত আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রদানের কাজটি যারা করে থাকেন তাদের উদ্ধারকারী দল বা রেসকিউ টিম বলে। প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা এ দল গঠিত হয়। এ দলের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিচে দেয়া হলোঃ
● আগুন লাগলে যতো দ্রুত সম্ভব ফ্লোর খালি করতে হবে,
● যত্রতত্র ছুটাছুটি হতে বিরত থাকতে বলতে হবে,
● কাছাকাছি বর্হিগমন পথ দেখিয়ে দিতে হবে,
● বের হবার পথ বাধামুক্ত রাখতে হবে,
● সম্ভব হলে অগ্নি নির্বাপনে এগিয়ে আসতে হবে,
● ফ্লোর, ষ্টোররুম, বাথরুম, টয়লেটে কেউ আটকে আছে কিনা দেখতে হবে,
● যে সকল লোক দ্রুত বের হতে পারে না/পারেনি তাদের বের হতে সাহায্য করতে হবে,
● স্ট্রেচার বা বিভিন্ন উদ্ধার পদ্ধতির সাহায্যে সজ্ঞান/অজ্ঞান ব্যক্তিদের বের করে আনতে হবে,
● প্রয়োজনে টুল বক্সে সংরক্ষিত কুঠার/লক কাটার/হাতুড়ি ব্যবহার করে আটকে পড়া লোকদের বের করার চেষ্টা করতে হবে,
● কেউ অনুপস্থিত থাকলে সংশ্লিষ্ট সুপারভাইজার/ইনচার্জ কে অবহিত করে তাকে খুঁজে বের করে উদ্ধারের ব্যবস্থা করে হবে।
 
 

প্রাথমিক চিকিৎসা দল

প্রাথমিক চিকিৎসক দল সাদা রং এর এপ্রোণ পড়ে, তার পিছনে লাল রং দিয়ে “প্রাথমিক চিকিৎসা” (First Aid) লিখা থাকে। হাসপাতালে নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আহত ব্যক্তির অবস্থার যেন অবনতি না ঘটে/যাদের শুধু হালকা চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া যাবে তার জন্য ঘটনাস্থলে তাৎক্ষনিক ভাবে বিজ্ঞান ভিত্তিক যে চিকিৎসা প্রদান করা হয় তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা বলে।
 
এসব দুর্ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারন অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই সেড়ে উঠেন/এম্বুলেন্স আসা পর্যন্ত আহত ব্যক্তিকে সাপোর্ট দেয়া যায়/ পঙ্গুত্ববরণ বা অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। রোগী ও তার আত্নীয় স্বজনদের অভয়দান ও আশ্বস্ত করতে হবে।
 
 

প্রাথমিক চিকিৎসাদানকারীর করণীয় কি? – What Should The First Aid Worker Do?

  • আহত বা আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে আগে,
  • আপনি ডাক্তার নন। তাই ডাক্তার আসার পূর্বে কাউকে মৃত বলে ঘোষণা করা যাবে না,
  • প্রাথমিক চিকিৎসার যে সকল উপকরন রয়েছে তা ব্যবহার করে সেবা দেয়া,
  • তাড়াহুড়ো না করে সময় নিয়ে দক্ষতার সাথে সেবা দেওয়া,
  • আহত ব্যক্তি যাতে কষ্ট না পান সেদিখে খেয়াল রাখতে হবে,
  • আহতদেরকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে বলা/পৌছানোর ব্যবস্থা করা,
  • প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো উত্তম ব্যবস্থাপনা ও সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
 
 

 

প্রাথমিক চিকিৎসা বক্সে যে সকল সরঞ্জামাদি ও ঔষধ রাখাহয় তার নমুনা – First Aid Box Material List

  • ১টি প্রাথমিক চিকিৎসার প্রচারপত্র,
  • বেদনানাশক বড়ি, পোড়ার জন্য ব্যবহার্য মলম,
  • ৬টি ত্রিকোনাকৃতির ব্যান্ডেজ,
  • ২৪টি ছোট জীবাণুমুক্ত করণ ব্যান্ডেজ,
  • ১২টি মাঝারি সাইজের জীবাণুমুক্ত করণ ব্যান্ডেজ,
  • ১২টি বড় সাইজের জীবাণুমুক্ত করণ ব্যান্ডেজ,
  • ১২টি (২ ইঞ্চি চওড়া) রোলার ব্যান্ডেজ,
  • ১২টি (৪ ইঞ্চি চওড়া) রোলার ব্যান্ডেজ,
  • এলকোহল দ্রবন ভর্তি ১টি বোতল (৪ আউন্স),
  • রক্তপাত নিবারনের সামগ্রি,
  • ২ প্যাকেট সেফটি পিন,
  • ২টি সিজার,
  • হাড়ভাঙ্গার ক্ষেত্রে ব্যবহার্য টুকরা,
  • ১বোতল রেফটিফাইড স্পিরিট (৪ আউন্স)
  • ১২টি জীবাণুমুক্ত তুলার প্যাকেট (১/২ আউন্স) ইত্যাদি।
 
 
 
 

অগ্নি মহড়া বা ফায়ার ড্রিলে সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় আইনসমূহ – Fire Drill Laws

  • প্রতি মাসে ১বার হলেও ফায়ার ড্রিল করা ও রেজিষ্টার খাতায় তার তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে,
  • প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার ফায়ার ড্রিল ও দুর্ঘনার সময় জরুরি নির্গমনের মহড়ার আয়োজন করতে হবে এবং রেজিষ্টারে সংরক্ষণ করতে হবে। এ মহড়া আয়োজনের কমপক্ষে ১৫দিন পূর্বে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক এবং নিকটস্ত ফায়ার সার্ভিস স্টেশনকে লিখিতভাবে তা জানাতে হবে।
  • প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় আগুন লাগলে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং অগ্নি নির্বাপক বিধিমালা যথাযথ কার্যকর করার লক্ষ্যে একটি বিস্তারিত ‘অগ্নি নির্বাপনী পরিকল্পনা’ প্রস্তুত করতে হবে,
  • যে প্রতিষ্ঠানে নীচ তলার উপরের তলার কোন স্থানে দশজন বা তার অধিক লোক কাজ করে অথবা অতিদাহ্য পদার্থ, বিস্ফোরক ব্যবহৃত বা গুদামজাত করা হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের অগ্নি কান্ডকালীন করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে,
  • নবনির্মিত সকল কারখানা ও বিধ্যমান পুরাতন কারখানার জন্য প্রথম ২ বছরের জন্য প্রতি বছর ৪ বার এবং ২ বছর পর থেকে সকল কারখানার জন্য প্রতি বছর ২ বার অগ্নি মহড়া করতে হবে,
  • ৫০ জন বা তার অধিক শ্রমিক অথবা কর্মচারী সম্বলিত কাঁরখানা ও প্রতিষ্ঠানে প্রতি ছয় মাসে নূন্যতম ১ বার ফায়ার ড্রিল করতে হবে ও রেজিষ্টার খাতায় তার তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে,
  • প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক বিভাগে নিযুক্ত শ্রমিকের কমপক্ষে ১৮% শ্রমিককে অগ্নি নির্বাপক, উদ্ধার, প্রাথমিক চিকিৎসা ও বহনযোগ্য অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষন দিতে হবে এবং এই প্রশিক্ষন প্রাপ্ত শ্রমিকদের মধ্য থেকে অগ্নি নির্বাপক দল, উদ্ধারকারী দল ও প্রাথমিক চিকিৎসা দল গঠন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button